পৃথিবীতে কাশ্মীরের তিনটি অংশ। একটি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর, যার নাম আজাদ কাশ্মীর এবং এই আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী হচ্ছে মুজাফফরবাদ। চীনের মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরের আরেকটি অংশ, এটি মূলত চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। তবে কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় অংশ রয়েছে ভারতের শাসনে।
ভারতে কাশ্মীরের অংশটি একটি স্বতন্ত্র রাজ্য। এই রাজ্যের নাম হচ্ছে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর। এই জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের তিনটি অঞ্চল রয়েছে। একটি হচ্ছে হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু অঞ্চল, যে অঞ্চলটির সবচেয়ে বড় শহর হচ্ছে জম্মু। জম্মু ভারতের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শীতকালীন রাজধানী।
আরেকটি হচ্ছে বৌদ্ধ অধ্যুষিত লাদাখ অঞ্চল। লাদাখ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু আর শীতল মরুভূমি।
বাকি থাকে কাশ্মীর উপত্যকা অংশ। আমরা বাংলাদেশিরা কাশ্মীর বলতে মূলত এই কাশ্মীর উপত্যকা ও এর আশপাশকেই বুঝে থাকি। এই অংশটির সবচেয়ে বড় শহর হচ্ছে শ্রীনগর। শ্রীনগর ভারতের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।
কাশ্মীর শব্দটি ভাবলেই আমাদের চোখের সামনে তিনটি বিষয় ভেসে ওঠে :
১। কাশ্মীর মানেই ভূস্বর্গ—সত্যিই ভূস্বর্গ, এবং এই ব্যাপারটি কখনোই ক্যামেরার চোখ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র নিজে স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত হয়ে অনুধাবন করতে হয়।
২। কাশ্মীর মানেই অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ—আসলে এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা শুধু প্রার্থনাই করতে পারি। তবে কাশ্মীরে যতই যুদ্ধাবস্থা তৈরি হোক না কেন, কখনোই কোনো পর্যটক আহত বা আক্রান্ত হননি। আর বাংলাদেশি পর্যটকরা কাশ্মীরি সাধারণ জনগণের কাছে অতিরিক্ত ভালোবাসাই পেয়ে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তাদের প্রিয় দল এবং তারা সবাই সাকিব আল হাসানের অন্ধ ভক্ত।
৩। কাশ্মীর ভ্রমণ মানেই বিরাট খরচের ধাক্কা—এটি সবচেয়ে ভুল ধারণা। কাশ্মীর শুধু দৃশ্যগত দিক দিয়েই ভূস্বর্গ নয়, যারা খুবই কম খরচে কাশ্মীর ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের পক্ষেও ভূস্বর্গ বটে। বিশেষ করে বাংলাদেশি ও সাকিব আল হাসানের দেশের লোক জানালে খরচ এমনিতেই অনেকখানি কমে যায়।
শ্রীনগর শহরকে ‘পূর্বের ভেনিস’ বলা হয়। এখানে যেমন আছে ডাল লেক, নাগিন লেক, একই সাথে আছে মোঘল বাগানগুলো। আসলে পুরো শ্রীনগর শহরটাই একটি দ্রষ্টব্য। শহরটিও যেমন সুন্দর, তেমনি এর মানুষগুলোও সুন্দর। ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য না দেখে শুধুমাত্র কাশ্মীরের সুন্দর মানুষগুলো দেখার জন্য হলেও শ্রীনগরে যাওয়া যায়।
শ্রীনগর শহরের পর্যটন প্রাণকেন্দ্রটি মূলত ডাল লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে। ডাল লেককে ‘কাশ্মীরি মুকুটের রত্ন’ বলা হয়। পাহাড়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা এই ২৬ বর্গ কিলোমিটারের অপরূপ সুন্দর জলাশয়টি আমাদের হ্রদ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেই বদলে দেয়।
এই ডাল লেকে আছে ৭০০টির বেশি হাউজবোট। হাউজবোট হচ্ছে পানির ওপর ভাসমান বাড়ি, যা পর্যটকদের থাকার জন্য গড়ে উঠেছে। অপূর্ব কারুকার্যখচিত এই হাউজবোটগুলোতে রয়েছে থাকার জন্য সব প্রকার আধুনিক আরামদায়ক ব্যবস্থা। শোবার ঘর, বসার ঘর, খাবার ঘর, গরম পানির বাথরুম, চোখ ধাঁধানো ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে পা ডুবে যাওয়া নরম কার্পেট পর্যন্ত সবকিছু।
বিভিন্ন ক্যাটাগরির হাউজবোট রয়েছে ডাল লেকে। প্রকারভেদে বিভিন্ন হাউজবোটে প্রতিরাত কাটানোর জন্য ভাড়া গুনতে হবে ৫০০ রুপি থেকে শুরু করে ৭৫০০ রুপি পর্যন্ত। মৌসুম ভেদে এটি কম-বেশি হয়ে থাকে। তবে দরদাম করে নিলে সবচেয়ে ভালো হয়।
যেহেতু হাউজবোটগুলো ডাল লেকের মাঝামাঝি বা অপর প্রান্তে ভাসমান অবস্থায় থাকে, এজন্য তীর থেকে হাউজবোটগুলোতে যাওয়ার জন্য ছোট ছোট নৌকায় চড়তে হয়। ছোটছোট এই নৌকাগুলোকে শিকারা বলে। হাউজবোটের হোটেল ভাড়া করলে মূল ভূখণ্ড থেকে হাউজবোটে শিকারায় চেপে যাওয়া-আসা করতে বাড়তি কোনো খরচ দিতে হয় না।
তবে ডাল লেকে প্রধান আকর্ষণ শুধু হাউজবোটে রাত্রিযাপনই নয়, বরং শিকারায় চেপে অপরূপ এই হ্রদটির এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো। পুরো ভাসমান আস্তো শহর আছে এই ডাল লেকে—বাজার থেকে শুরু করে পোস্ট অফিস পর্যন্ত। নৌকায় ভাসমান এই বাজারে বিখ্যাত কাশ্মীরি পশমিনা শাল থেকে শুরু করে মনোলোভা কাশ্মীরি কাবাব সবকিছুই পাওয়া যায়।
ডাল লেক শুধু প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর নয়, কৃত্রিমভাবেও একে মোহনীয় করা হয়েছে। লেকের মাঝে রয়েছে কৃত্রিম ফোয়ারা।
এছাড়া লেকটিতে হাঁসসহ বিভিন্ন পাখি মুক্তভাবে চড়ে বেড়ায়। তাদের জলকেলি দেখাও কম আনন্দের নয়।
এছাড়া ডাল লেকের মাঝখানে একটি দ্বীপের মাঝে গড়ে উঠেছে ‘নেহেরু পার্ক’। ছোট্ট সুন্দর এই পার্কটিতে আছে চা খাওয়ার জন্য খুবই সুন্দর জায়গা। চাইলে এখানে দুপুরের খাবারও খাওয়া যায়। পার্কটিতে যেতে হলে অবশ্যই শিকারাতে উঠতে হবে। এছাড়া ছোট্ট এই দ্বীপটিতে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
ডাল লেকের মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত নেহেরু পার্ক।
শিকারায় চেপে ডাল লেক ঘুরতে হলে ঘণ্টা প্রতি খরচ হবে ৩৫০ রুপি থেকে শুরু। মৌসুম ভেদে খরচ ওঠা-নামা করে। তবে সমসময়ই দরদাম করতে হবে।
ডাল লেকের ডান পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটির নাম হচ্ছে ব্যুলেভার্ড রোড। এই সড়কের পাশজুড়ে আছে খুবই সুদৃশ্য কিছু উদ্যান। সেগুলো দেখলে এমনিতেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
ব্যুলেভার্ড রোডের পাশে সুদৃশ্য পার্ক।
ডাল লেকের ভাসমান হাউজবোট ছাড়াও আশপাশে অনেক থাকার হোটেল আছে। এগুলোর ভাড়া ১৫ হাজার রুপি পর্যন্ত। তবে আমি ছিলাম ডাল লেকের একটি অংশ ডাল গেটে অবস্থিত একটি হোটেলে—নাম ‘DHAM DHAM’ বাংলায় লেখা ছিল ‘দমদম’। হোটেলের মালিক কিন্তু একেবারেই বাংলা বোঝেন না। কিন্তু বাংলায় দমদম লেখা কেন জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন যে, কলকাতা থেকে নাকি প্রচুর বাঙালি ট্যুরিস্ট তার হোটেলে ওঠেন, এজন্য এমন নাম। গরম পানির এটাস্ট বাথরুমসহ ডাবল বেডের রুমের ভাড়া ছিল ৫০০ রুপি।
কম খরচে শ্রীনগর সাইট সিয়িং করার জন্য আমরা শ্রীনগর শহরটিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি।
১। ডাল লেকের ডান পাশে ব্যুলেভার্ড রোড
এই রুটে যে দর্শনীয় স্থানগুলো পড়বে তা হচ্ছে :
ক) শালিমার বাগ
খ) নিশাত বাগ
গ) বোটানিকাল গার্ডেন
ঘ) টিউলিপ গার্ডেন
ঙ) চশমাশাহী
চ) পরিমহল
২। ডাল লেকের বাম পাশ ধরে হযরতবাল রোড।
এই রুটে যে দর্শনীয় স্থানগুলো পড়বে তা হচ্ছে :
ক) হযরত বাল মসজিদ।
খ) গুরুদুয়ারা
গ) কাথি দরওয়াজা
ঘ) বাদাম ওয়ারি পার্ক
ঙ) দূররানী দুর্গ
চ) জামিয়া মসজিদ
৩। শ্রীনগর শহরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান:
ক) লাল চক
খ) ঝিলাম নদী
গ) শ্রীনগর রেল স্টেশন
ঘ) শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উদ্যান
এই দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য ট্যুরিস্টরা সাধারণত ট্যাক্সি ভাড়া করেন। শহরের বিভিন্ন স্থানে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে। সেখানে কোন রুটের ট্যাক্সি রিজার্ভ করলে কত রুপি লাগবে, তার তালিকা দেওয়া আছে। উপরোক্ত স্থানগুলো দেখতে মোটামুটি দুদিন লাগবে। ট্যাক্সি ভাড়া পড়বে প্রায় পাঁচ হাজার রুপি। তবে লোকাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করলে ২০০ রুপিরও কম খরচে এই স্থানগুলো দেখা সম্ভব।